• ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

শিল্পায়নের জন্য মালিক-শ্রমিকদের এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

sylhetsurma.com
প্রকাশিত মে ২, ২০১৭

সিলেট সুরমা ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মে দিবসের চেতনাকে ধারণ করে শ্রমিক এবং মালিক পক্ষকে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এক সঙ্গে কাজ করে দেশকে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আজকের এই মে দিবসে আমাদের সকল মেহনতি শ্রমিক ভাই-বোনদেরকে এবং মালিক পক্ষকে আমি এটুকুই বলবো, এই মে দিবসের চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সকলে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মালিক শ্রমিক সম্পর্ক হতে হবে হৃদতাপূর্ণ। একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করলেই কেবল দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আর এটুকু ভরসা রাখবেন- যে, আমার রাজনীতি আপনাদের জন্য, বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষের জন্য। কাজেই আমি আছি আপনাদের সঙ্গে।’
শেখ হাসিনা ১ মে বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত মে দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে কোনরকম উস্কানিতে কান না দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বহি:বিশ্বে দেশের সুনাম বৃদ্ধিতেও শ্রমিকদের কাজ করে যাবার আহবান জানান। একইসঙ্গে তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান এমপি এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’র (আইএলও) কান্ট্রি অফিসের পরিচালক শ্রীনিবাস বি রেড্ডী।
অনুষ্ঠানে মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি শুকুর মাহমুদ, তৈরী পোষাক শিল্প মালিকদের পক্ষে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান এবং কর্মজীবীদের পক্ষে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান বক্তৃতা করেন।
স্বাগত বক্তৃতা রাখেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মে দিবসের যে সংগ্রামী চেতনা, সেই চেতনাকে মাথায় নিয়েই আমাদের দেশকে ধীরে ধীরে আমরা শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমাদের দেশ উন্নত হবে। বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত হবে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা পালন করবো একটি দারিদ্রমুক্ত উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা শ্রমের মর্যাদা এবং শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা যথাযথভাবে মিটিয়ে দেয়ার আহবান জানিয়ে মালিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, মুনাফা অবশ্যই করবেন। তবে তা যেন শোষণে পরিণত না হয়। শ্রমিকদের বঞ্চিত করে শিল্পের উন্নয়ন হবে না। কারণ শ্রমিক হচ্ছে কারখানার প্রাণ।
প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, শিল্প টিকে থাকলেই কেবল আপনাদের কর্মসংস্থান হবে। দারিদ্র্য দূর হবে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারবে। তাই শিল্পের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজে সম্পৃক্ত হবেন না।
তিনি বলেন, কাজেই মালিক শ্রমিক সম্পর্ক হতে হবে হৃদ্যতাপূর্ণ। একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করলেই কেবল দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।
শেখ হাসিনা শ্রমিক ও মালিক পক্ষকে আশ্বস্থ করে বলেন, ‘সরকার সবসময়ই আপনাদের পাশে আছে। কোন সমস্যা হলে অবশ্যই আমরা আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করতে পারব।’
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা,সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথি এবং শ্রমিক ও মালিক পক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি’ দিবস। শ্রমের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের মর্যাদা রক্ষা করা এবং দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে শ্রমিকরা তিনদিনের সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে শ্রমিক সমাবেশে গুলিবর্ষণ করা হয়। বহু শ্রমিক মারা যায়। তাঁদের সেই মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই পরবর্তিতে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের দাবি অর্জিত হয়। সেই থেকেই সারাবিশ্বে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বা ‘মে দিবস’ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

‘শ্রমিক মালিক গড়বো দেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’-এবারের মে দিবসের এই প্রতিপাদ্যটি যথার্থ হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার শ্রমনীতি বাস্তবায়ন ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
তিনি বলেন, ‘জীবনধারণের ব্যয়, মূল্যস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও পুনঃনির্ধারণ প্রক্রিয়া রাখা এবং এজন্য মজুরী কমিশন ও সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা শ্রেণি আছে যাদের কাজই হচ্ছে ত্রুটি খুঁজে বের করে বদনাম করা। যেটা আমাদের শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলে গেছেন, দেশে তাদের কোন খবর নেই। তবে, তারা কিছু হলেই কেবল বিদেশে ম্যাসেজ পাঠানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাতে লাভ কি? তারা কি ভাড়া খাটেন? কোন বিদেশী এজেন্সীর ভাড়া খেটেই এটা করেন কিনা, আমার সন্দেহ। নইলে দেশে কি ঘটনা ঘটলো তা দেশে বসে সমাধান না করেই মুরুব্বি খুঁজতে যাবেন পরদেশে! তারা এসে কি করবে, খবরদারি করবে। আর এই খবরদারির ফলে যদি ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যায়, তবে যারা এসব ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন তাদের ভাগ্যে কি জুটবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আজ দেশ বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের রোল মডেল। এই সম্মান আমাদের ধরে রাখতে হবে। যারা কথায় কথায় বিদেশীদের কাছে নালিশ করতে যান-তারা যে নিজে দেশ, মালিক, মানুষ এবং ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করেন, এটা তারা কেন উপলব্ধি করতে পারেন না? সেটা আমি বুঝতে পারি না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আজকের দিনে বাংলাদেশের সকল শ্রমিক ভাই এবং প্রবাসেও যারা রয়েছেন-তাদের বলব, যে যেখানে আছেন তারা যেন সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন। কারণ যার মাধ্যমে আপনার জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয় সেটা যেন সচল থাকে। সেই সচল রাখার দায়িত্ব আপনাদের।
তথাকথিত নেতৃত্বের দাবিদারদের উস্কানিতে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্তত এটুকু বলতে পারি আমার রাজনীতি বাংলাদেশ এবং এদেশের জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে। জনগণের উন্নয়নের জন্য এখানে আমাদের চাইতে আর কারো দরদ বেশি উথলে উঠতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। আমি এটুকু বলব, আপনারা শ্রমিক ভাইয়েরা এদেশের কল্যাণে শ্রম দেন। তাদের বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন করা লাগবে না।
ইতোপূর্বে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে নিজস্ব উদ্যোগ এবং শ্রমিকদের পক্ষে বার্গেনিং এজেন্ট হিসেবে মালিকপক্ষের সঙ্গে যুক্তিতর্কে অংশ নিতে তাঁর উদ্যোগ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদের মধ্যেও আমরা শ্রমিকের কল্যাণে গত আট বছরে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। আমরা পোশাক শ্রমিকের মজুরি তিন দফা বাড়িয়েছি। ন্যূনতম মজুরি ১ হাজার ৬শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার ৩শ’ টাকায় উন্নীত করেছি। শ্রমিকদের জন্য রেশনিং প্রথা চালু করেছি। শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতাল, ডরমেটরি নির্মাণ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ভবন ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘গার্মেন্টস শিল্প বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। আইএলও কনভেনশনের আলোকে তাঁর সরকার শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন করেছে এবং শ্রমনীতি ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর বিধিমালাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। ‘আমরা জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা-২০১৩ প্রণয়ন করেছি।’
তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্স ইস্যুটিকে তাঁর সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এ শিল্পের উন্নয়নে আইএলও’র সহায়তায় ত্রিপক্ষীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন করেছি। ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের চাহিদানুযায়ী আমরা দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলছি। বিভিন্ন ট্রেডে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এশিয়া ও ইউরোপসহ মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে সম্মানজনক চুক্তিতে এবং বিভিন্ন দেশে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সরকার প্রচলিত অনলাইন রেজিস্ট্রেশন না করে কোন প্রকার দালালের দ্বারস্থ হয়ে নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে প্রবাসগামীদের সতর্ক করেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রী দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাদের জন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৮ সালে এ তহবিলে জমা ছিল মাত্র ৮ লাখ টাকা। বর্তমানে এ তহবিলে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২শ’ কোটি টাকার বেশি।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।