• ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

সিলেটে শিলংয়ের পর নাইট তীর মহামারী আকার ধারণ করেছে 

sylhetsurma.com
প্রকাশিত অক্টোবর ২৭, ২০১৭

বিশেষ প্রতিবেদন: তীরের পর তীরে বিদ্ধ হচ্ছে সিলেট। নিঃস্ব হয়ে পড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। রাতারাতি টাকাওয়ালা বনে যাওয়ার আশায় দিনের রোজগারের টাকা রাতে ঢালছেন জুয়ার বোর্ডে। মাঝখানে প্রতিদিন খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে সিলেটে।

খেলার নাম হচ্ছে ‘শিলং তীর’। শুধু নগর নয় গোটা জেলার সব বয়েসী মানুষ জানে এই খেলার নাম। ইন্টারনেটনির্ভর এই খেলা ইতিমধ্যে সিলেটে মহামারী আকার ধারণ করেছে। এবার কেবল শিলং তীরই নয় , এবার দেশীয় নাইট তীরেও বিদ্ধ হচ্ছে সিলেট। আর যারা এই শিলং তীর খেলছেন তারাই আবার দেশীয় নাইট তীর খেলায় অংশ নিয়ে দ্বিগুণহারে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।

তীর খেলা নিয়ে সিলেটে পুলিশ প্রশাসনের ঘুম প্রায় হারাম। গেল দুই মাসে সিলেট মহানগর পুলিশ তীর খেলার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক জুয়াড়িকে। সাম্প্রতিক সময়ে ফের অভিযান জোরদার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে আরো ২০ জন। কিন্তু কোনো ভাবে রোখা যাচ্ছে না শিলং কিংবা দেশি নাইট তীর সিন্ডিকেটদের। সিলেটের পাশেই ভারতের খাসিয়া অধ্যুষিত মেঘালয় রাজ্য।

এই রাজ্যের রাজধানী হচ্ছে শিলং। অনেক আগে থেকে শিলং তীর নামে একটি জুয়া খেলা মেঘালয়ে প্রচলিত রয়েছে। পরবর্তীতে খেলাটি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে আসে সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায়। এই দুই থানা হয়ে পরে সেটি চলে আসে সিলেটে। এখন সিলেটে নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে শিলং তীর। প্রতি পাড়ায় পাড়ায় নিয়ন্ত্রকরা এসব খেলা পরিচালনা করছে। সিলেটের যেকোনো এলাকায় বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা শিলং জুয়ায় বাজি ধরছে।

এ খেলাটি সপ্তাহের ছয়দিনই বসছে। প্রতিদিন দুইবার এ খেলার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। সিলেটে তাদের এজেন্টের মাধ্যমে এদেশীয় এজেন্টরা ভারতের এজেন্টদের সঙ্গে জুয়ার আসরের সমন্বয় করে। আর ভারতীয় এ ভাগ্যের খেলায় স্কুল-কলেজের ছাত্র, দিনমজুর, রিকশাচালক, যানবাহনের চালক-শ্রমিকসহ বেকার যুবকরা অংশ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে গেছে শিলং তীরের নামে। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেছে, এদেশের এজেন্টদের মাধ্যমে ০-৯৯ পর্যন্ত নাম্বার বিক্রয় করা হয় যেকোনো মূল্যে।

লটারিতে ০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত যেকোনো সংখ্যা কিনে নেয়া যায়। সর্ব নিম্ন ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাজি ধরা যায়। যত মূল্যে সংখ্যাটি বিক্রয় হবে তার ৭০ গুণ লাভ দেয়া হবে বিজয়ী নম্বরকে। অর্থাৎ ১০ টাকায় ৭০০ টাকা। একই নম্বর একাধিক লোকও কিনতে পারেন। সবাই কেনা দামের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি টাকা পাবেন। প্রতিদিন বিকাল সোয়া ৪টায় ও সাড়ে ৫টায় দু’বার এ লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়। খেলার ফলাফল দেয়া হয় অনলাইনে। ভারতের শিলং থেকে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জুয়ার আসরটি পরিচালনা করা হয়।

শিলং তীরে ইতিমধ্যে কাবু সিলেট। এরই মধ্যে দেশীয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নাইট তীর নামেও খেলা শুরু হয়। আলাদা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশীয় তীর সিন্ডিকেটরা এ খেলা পরিচালনা করে। রাত সাড়ে ১০টা ও রাত সাড়ে ১১টায় এই তীর খেলার ফলাফল ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। সিলেটে এখন শিলং তীরের মতো নাইট তীরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে দেশের কোথা থেকে নাইট তীর পরিচালনা করা হয় তার কোনো হদিস মিলেনি। কিন্তু সিলেটে এর বিশাল একটি সিন্ডিকেট রয়েছে।

এই সিন্ডিকেটরা এজেন্টদের মাধ্যমে খেলা পরিচালনা করে। এর মধ্যে দক্ষিণ সুরমার ওই তীর সিন্ডিকেটের সদস্যরা অবস্থান নিয়ে খেলা পরিচালনা করে। নগরীর তালতলা, শেখঘাট, সুরমা মার্কেট, মেন্দিবাগ সহ কয়েকটি এলাকায় নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে নাইট তীর পরিচালনা করা হয়। তবে এরই মধ্যে নাইট তীরের খেলা নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের মনে কিছুটা সন্দেহ বেধেছে। কারণ নাইট তীর সিন্ডিকেট সদস্যরা নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য কখনো কখনো ফলাফল পাল্টে ফেলে বলে ধারণা করছেন অংশগ্রহণকারীরা। আর ওয়েবসাইটে ফলাফল ঘোষণার আগে কখনো কখনো এজেন্টদের মাধ্যমেও ফলাফল জানিয়ে দেয়া হয়।

শিলং তীরের মতো নাইট তীরে ইতিমধ্যে গ্রাস করে ফেলেছে কাজিরবাজারের কাঁঠালহাটা, সুরমা মার্কেট, শেখঘাট, বেতেরবাজার, শামিমাবাদ, নবাব রোড, লালাদিঘির পাড়, বিলপাড়, ছড়ার পাড়, রিকাবীবাজার, কাজলশাহ্‌, বাঘবাড়ী, মদিনা মার্কেট, আখালিয়া, নিয়ারীপাড়া, ধানুকাটা, গোয়াবাড়ী, কালীবাড়ী, নতুন বাজার, কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড, তেমুখী, টুকের বাজার, বালুচর, টিলাগড়, আম্বরখানা, মেন্দিবাগ, কদমতলীসহ শহরের কয়েকশ’ স্পট। এদিকে সিলেটে তীর খেলা বন্ধ করতে সিলেট মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বেশকিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

কয়েকটি বড় আস্তানা চিহ্নিত করে তারা অভিযান পরিচালনা করে শত শত মানুষকে জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মালামাল সহ তাদের আদালতে সোপর্দ করা হলেও আইনের ফাঁকফোকর গলে তারা বেরিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। তাৎক্ষণিক শাস্তিও দেয়া হয়। কিন্তু তীর সিন্ডিকেটের সদস্যরা কিছুটা কারাবরণ করে ফের বেরিয়ে এসে খেলা শুরু করে।

সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি বিভূতি ভূষণ ব্যানার্জি জানিয়েছেন তীরের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) মেডিকেল এলাকার শাহজাহানের আস্তানা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে দুইদিনে প্রায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু তীর খেলা বন্ধ হয় না।

তিনি বলেন, তীর খেলা বন্ধ করতে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। সামাজিকভাবে সচেতনতা বাড়াতে পারলে তীর খেলা দ্রুত বন্ধ করা যাবে বলে জানান তিনি।