• ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

দক্ষিণ সুরমায় দুই নেতার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

sylhetsurma.com
প্রকাশিত অক্টোবর ২৩, ২০১৬
দক্ষিণ সুরমায় দুই নেতার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

এম এ মালেক :::  আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দক্ষিণ সুরমার কুচাই ইউনিয়ন উত্তপ্ত করে তুলছেন দুই নেতা। তাদের যন্ত্রণায় সম্প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন এলাকাবাসী। তাদের ব্যক্তিগত কোন্দল ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা এলাকায়। এতে যে কোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ। এ দুই নেতার হীন কার্যকলাপের কারণে কুচাই ইউনিয়নে বর্তমান সরকার দল আওয়ামী লীগে গ্রুপ উপ-গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি বিদ্যমান। কুচাই ইউনিয়নের দক্ষিণ সুলতানপুর গ্রামের মৃত হাজী আইয়ুব আলী দ্বারা মিয়ার ছেলে হাজী গুলজার আহমদ ও কুচাই গ্রামের মৃত আলতাব উদ্দিনের ছেলে ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন মিঠুর মধ্যে চলছে এ বিরোধ।

দু-জনের মধ্যকার এ বিরোধ শুধু এলাকাতে নয়, সোস্যাল মিডিয়ায় সমানতালে চলছে পক্ষে বিপক্ষে প্রচার প্রচারণা, নিন্দা ও প্রতিবাদ। সরেজমিন কুচাই এলাকা ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। ঘটনার সূত্রপাত বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনের পূর্বে কুচাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে গুলজার আহমদ নিজের ছবি ও আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে এলাকায় ব্যানার ফেস্টুন পোস্টার লাগিয়ে প্রচারণা শুরু করেন, পরে আওয়ামী লীগের উপর মহলের নির্দেশে তিনি নির্বাচন থেকে সরে আসেন। তখন দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয় তরুন সমাজসেবী ও যুবলীগ নেতা জাকিরুল আলম জাকিরকে।

এ নির্বাচনে প্রথমে এক ঘরের দুই ভাই চেয়ারম্যান হিসেবে প্রার্থী হওয়ায় এলাকায় সেই সময়ে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, গুলজার আহমদ ও তার আপন চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা পরপর চারবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আবুল কালামের প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে প্রার্থী হন তিনি।
চলতি বছরের ৭ জুনের নির্বাচনে আবুল কালাম বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। জাকিরুল আলম জাকিরের ভরাডুবির পেছনে আওয়ামী লীগের গ্রুপিং রাজনীতিকেই দায়ি করেন অনেকে। গুলজার আহমদের মতো ঐ নির্বাচনের পূর্বে কুচাই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন মিঠু চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীতা ঘোষনা করে চারিদিকে ছবি সম্ভলিত পোস্টার লাগিয়েছিলেন, পরে দলীয় নির্দেশে তিনি ও নির্বাচন থেকে সরে আসেন।

তখন খোদ ইউনিয়ন যুবলীগের মধ্যে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়, বর্তমানে একটির নেতৃত্বে রয়েছেন মিঠু, আর আড়ালে থেকে অপরটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন গুলজার আহমদ।
অপরদিকে কুচাই আওয়ামী লীগের মধ্যেও দুটি গ্রুপের সৃষ্ঠি হয়েছে। বর্তমান কুচাই আওয়ামী লীগের সভাপতি আনা মিয়া ইউনিয়নে নেতৃত্ব প্রদান করলেও গুলজার আহমদ এককভাবে নিজে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি গুলজার আহমদ ও ইকবাল হোসেন মিঠুর মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ।

গত ১৮ অক্টোবর মঙ্গলবার গুলজার আহমদ মোগলাবাজার থানায় নিজের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে ইকবাল হোসেন মিঠুর নাম উল্লেখ করে একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। যার নং- ৭১১, সাধারণ ডায়েরীতে গুলজার উল্লেখ করেন, তিনি সুরমা এক্সপ্রেস লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এবং তার নামীয় সুরমা এক্সপ্রেস লিমিটেড এর অধীনে ২০টি বাস ঢাকা-সিলেট সড়কে চলাচল করে। তার ব্যানারে বিভিন্ন বাস মালিকের গাড়ীও চলাচল করে। তাছাড়া তিনি ব্যবসায়ীক কর্মকান্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে সামাজিক কর্মকান্ড ও সমাজসেবায় নিয়োজিত এবং দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী হিসাবে দলের প্রতি নিবেদিত হয়ে সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছেন। এলাকার অসহায় গরীব লোকদের সাহায্য সহযোগিতা সহ বেকারত্বের ফলে বখে যাওয়া ও অপরাধ জগতে প্রবেশ করা তরুণ যুবকদের বেকারত্ব দূরীকরণ ও অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আর্থিক সহায়তা করে ব্যবসা বাণিজ্য করার পরামর্শ প্রদান করে আসছেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ইকবাল হোসেন মিঠু একই ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং সে চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, দস্যুতা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকে।

তার কৃত অপরাধের কারণে কোতোয়ালী থানা ও দক্ষিণ সুরমা থানায় একাধিক মামলা মোকদ্দমা হয়েছে। ইকবাল হোসেন মিঠু অপরাধ জগতের কুখ্যাত ব্যক্তি হিসাবে তার ছবি দক্ষিণ সুরমা ও কোতোয়ালী থানার অপরাধী তালিকায় লটকানো ছিল। তাকে অপরাধ জগত থেকে নিবারনের জন্য গুলজার আহমদ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এবং বিভিন্ন সময় আর্থিক সহযোগিতা করে আসছেন। কিন্তু ইকবাল হোসেন মিঠু তার নিকট থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে খরচ করে পুনরায় টাকা নিয়ে থাকে। তিনি তাকে এইভাবে বার বার টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ইকবাল ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। সে পরস্পর বলাবলি করতে থাকে যে, তার প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল, রাস্তায় চলাচলরত গাড়ী, অফিস ইত্যাাদিতে প্রায় সময় গাড়ী রাখিয়া তিনি ব্যক্তিগত কাজে অথবা অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত থাকলে তার গাড়ী ভাংচুর, টায়ার পাংচার, গাড়ী চুরি করে আর্থিক দাবি পূরণ করবে বলে হুমকি দেয়। গত ১৭ অক্টোবর দিবাগত রাত অনুমান সাড়ে ৭ টায় কুচাই ইউনিয়ন আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে গিয়ে ইকবাল হোসেন মিঠু গুলজার আহমদের খোঁজ করতে থাকে। তাকে না পেয়ে কার্যালয়ে উপস্থিত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জানায় যে, সে গুলজার আহমদের যে কোন ধরনের ক্ষতি করিবে। না হয় ইকবালের কথামতো গুলজার আহমদকে চলতে হবে। গুলজার আহমদের মোবাইল নং-০১৭১১-৪৪৪৮৬৬ এবং ০১৯৭১-৪৪৪৮৬৬ দিয়ে রাত অনুমান সাড়ে ৮-৯টায় ইকবাল আহমদ মিঠুর মোবাইল নং-০১৯২০-০৯৫৬৭৬ তে কল করে লাউড স্পিকার দিয়ে তাকে খোজার কারণ জিজ্ঞেস করেন এবং হুমকি দেওয়ার কারণে জিজ্ঞাসা করিলে সে তার সাথে অশ্লীল ভাষায কথা বলে এবং বলে যে, তাকে আর্থিক সাহায্য না দিলে গুলজার আহমদের প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল, সিলেট-ঢাকা রোডের সুরমা এক্সপ্রেস লিমিটেডের বাসে আঘাত, আক্রমন করিয়া যেকোন ধরনের ক্ষতিসাধন করবে এমনকি তার অপরাধ জগতের সহযোগিদের অপরাধের মাত্রা তাকে বুঝিয়ে দিবে বলে হুমকি প্রদর্শন করে। ইকবাল আরো হুমকি দেয় যে, যদি উক্ত বিষয় বাড়াবাড়ি বা আইনের আশ্রয় নেন, তাহলে গুলজার আহমদ সহ তার পরিবারের লোকজনকে প্রাণে হত্যা সহ যেকোন ধরনের ঘটনা ঘটাইবে অথবা তার সুরমা এক্সপ্রেস লিমিটেডের যানবাহনে অবৈধ মালামাল রেখে যাত্রী বা চালক/হেলপারদের ও মালিক হিসেবে তাকে ফাঁসাইয়া হয়রানী করবে বলে হুমকি দেয়। হুমকিদাতা ইকবালের কথা কার্যালয়ে উপস্থিত লোকজন লাউড স্পিকারে শুনেছেন বলে ও গুলজার তার সাধারণ ডায়েরীতে উল্লেখ করেন,
সাধারণ ডায়েরীর বিষয়ে গুলজার আহমদ জানান, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছেন। গুলজার আহমদের রাজনৈতিক পদবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি কুচাই ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের ১নং সদস্য।

অপরদিকে কুচাই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন মিঠু জানান, গুলজার  নিজেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কালো টাকার প্রভাব দেখিয়ে এলাকার মানুষকে জিম্মি করার পায়তারায় লিপ্ত রয়েছে। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে সে হয়ে যায় ছিনতাইকারী, চুর কিংবা ডাকাত । গুলজার পূর্বশত্রুতার জেরে গুলজার আহমদ মিঠুকে সমাজ ও আইনের চোখে অপরাধী বানানোর জন্যই মোগলাবাজার থানায় মিথ্যা হুমকির কথা উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরী করেছেন বলে জানান মিঠু।

অন্যদিকে থানায় গুলজার আহমদের সাধারণ ডায়েরীর সূত্রধরে বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যম ও স্থানীয় দৈনিকে মিঠুর বিরুদ্ধে একের পর এক সংবাদ প্রতিবেদন আসতে থাকে। গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ায় মিঠুর ছবিসহ সংবাদ প্রচার হওয়াতে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে রূপ নেয়। এলাকার স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিঘিœত হওয়ার কথা উল্লেখ করে কুচাই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন মিঠুর উপর দায়ের করা সাধারণ ডায়েরী ও অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় ৪নং কুচাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন। কুচাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রহমান আনা মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন জানান, যুবলীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন মিঠুর উপর আওয়ামী লীগ নামদারী গুলজার আহমদ কর্তৃক মিথ্যা সাধারণ ডায়েরী করে এলাকার সুনাম ক্ষুন্ন করেছেন। তারা জানান, যুবলীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন মিটু সৎ ও আদর্শবান একজন নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য ছিল ইকবাল হোসেন মিঠুু সেই লক্ষে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কুচাই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে সুসংগঠিত করে রেখেছেন। এমন নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাধারণ ডায়েরী ও অপপ্রচার করে যারা নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে পরিচয় দিচ্ছে তাদের এমন হীন অপচেষ্টা সফল হতে দেবেনা কুচাই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। তারা অবিলম্বে মিথ্যা সাধারণ ডায়েরী প্রত্যাহার ও বিশৃঙ্খরা সৃষ্টির জন্য তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তারা।

গুলজার আহমদ ও মিঠুর বিরোধের বিষয়ে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, এ ধরণের কর্মকান্ডে দলের সুনাম নষ্ঠ হচ্ছে, গুলজার আহমদ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই, তিনি পত্র-পত্রিকায় যেভাবে নিজেকে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিচ্ছেন, তা মিথ্যা, গুলজার আহমদ উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির কোনো সদস্য পদে ও নেই, আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষে এ বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সভা করে বিহীত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক বরইকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রইছ আলী বলেন, গুলজার উপজেলা আওয়ামী লীগের কেউ না, বর্তমানে কুচাইয়ে যে বিরোধ চলছে, তা সম্মেলনের পরপরই সবাই বসে এ বিরোধ নিস্পত্তি করবেন বলে জানান তিনি। কুচাই ইউপি ছাত্রলীগের সভাপতি ছাদেক আলী বলেন, মিঠু যুবলীগের সভাপতি, সে চুর ছিনতাইকারী নয়, থানায় গুলজার আহমদ কর্তৃক প্রদান করা সাধারণ ডায়েরীতে যা লিখা হয়েছে, তা নোংরামি ছাড়া আর কিছু নয়। কুচাই ইউপি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল লয়েছ বলেন, পদ-পদবিহীন নেতা গুলজার নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে যেসব কর্মকান্ড করছেন, তাতে এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, গুলজার আহমেদের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরীর সঠিক তদন্ত করলে তা মিথ্যা প্রমাণিত হবে, গুলজার আহমদ নব্য শিল্পপতি হয়ে টাকার অপ-ব্যবহার করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।