• ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

চা শ্রমিকের রেশনের নামেও চলে ফাঁকিবাজি

sylhetsurma.com
প্রকাশিত আগস্ট ২৯, ২০২২
চা শ্রমিকের রেশনের নামেও চলে ফাঁকিবাজি

সিলেট সুরমা ডেস্ক : চা শ্রমিকরা দৈনিক মজুরির বাইরে সুযোগ-সুবিধা হিসেবে যে খাদ্যসহায়তা পান, সেটি কেবল চাল ও আটার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার কোথাও কোথাও কেবল পাঁচ বছর ধরে টানা আটা দেয়ার তথ্য মিলেছে।

নিম্ন মজুরির কারণে এই চাল বা আটার সঙ্গে স্বাস্থ্যকর অন্য খাবারগুলো জোগাড় করতে না পারায় শ্রমিক এবং তার শিশুদের ভগ্ন-স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকারি জরিপেই উঠে এসেছে।

আবার এই রেশনের বিষয়টি শর্তমুক্ত নয়। চাষের জন্য যাদের জমি ইজারা দেয়া হয়, তাদের দেয়া হয় না রেশন, মাঝেমধ্যে ‘শাস্তি’ দিতে বন্ধ রাখা হয় এই সুবিধা।

অথচ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি ওঠার পর মালিকদের পক্ষ থেকে বারবার বেতনের বাইরে অন্য সুযোগ-সুবিধাগুলোর মধ্যে বারবার রেশনের বিষয়টি তোলা হয়।

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবি পূরণ হয়নি। তবে ‘মা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঠিক করে দেয়া ১৭০ টাকা মেনে নিয়ে কাজে ফিরেছেন। বলা হচ্ছে, এই মজুরির মতো আনুপাতিক হারে বাড়বে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, যে কারণে একেক জন শ্রমিক দিনে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা পাবেন।

তবে এই হিসাবের ভেতর আছে দিনে ৭৬ টাকা ৯২ পয়সার আবাসন সুবিধা। তবে নিউজবাংলা দেখেছে, ভাঙাচোরা যেসব ঘরে থাকতে দেখা যায়, সেসব ঘর দিয়ে মাসে ২ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি দেখানো হলেও গ্রাম এলাকায় এই ধরনের ঘরে টাকার বিনিময়ে কেউ থাকতে চাইবেন কি না, সেটি বিতর্কের বিষয়। আর যেগুলোর অবস্থা তুলনামূলক ভালো, সেগুলোর ভাড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার বেশি নয়।

রেশনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুরুষ শ্রমিককে সপ্তাহে ৩.২৭ কেজি, তার পোষ্য নারীকে ২.৪৪ কেজি এবং দুজন শিশুকে ১.২২ কেজি করে সপ্তাহে ৬.৯৩ কেজি চাল বা আটা দেয়া হয়। নারী শ্রমিকরা পুরুষের সমপরিমাণ রেশন পেলেও তাদের পোষ্যরা কিছু পান না। এ ছাড়া কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। কোনো শ্রমিকের ধানি জমি থাকলে তাকে রেশন দেয়া হয় না। অনিয়মিত শ্রমিকরাও তা পান না।

হবিগঞ্জের চাঁন্দপুর বাগানের শ্রমিক সুমন বাউড়ি বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে শুধু আটা দিয়েছে। এতে শ্রমিকদের ঠিকই চাল কিনতে হতো। গত মাস থেকে চাল দিচ্ছে।’

নারীনেত্রী সন্ধ্যা রাণী ভৌমিক বলেন, ‘শ্রমিকের বাচ্চা থাকলে আরও এক কেজি অতিরিক্ত দেয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিককে দেয়া হয় দুই কেজি করে। যাদের ধানি জমি আছে তাদের কানিপ্রতি দেড় কেজি করে কেটে নেয়া হয়।’

সুরমা চা বাগানের শ্রমিক সনকা সাঁওতাল বলেন, ‘যে রেশন দেয় তার মান ভালো না। আমরা কোনো রকমভাবে খেলেও আপনারা পারবেন না। এ ছাড়া বছরের পর বছর কি আটা খেয়ে থাকা যায়?’

তেলিয়াপাড়া বাগানের শ্রমিক মুরতি পাল বলেন, ‘পাঁচ বছর ধইরা শুধু আটা দিছে। এই আটা খাইয়া কত থাকমু। চাল কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও আমার নেই। তবুও ১২০ টাকা মজুরি থেকেই মাঝে মাঝে চাল কিনছি। গত মাস থেকে চাল দিতেছে। এ মাসে চাল কিনতে লাগছে না ‘

সিলেটের সরকারি লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক রমনী ভূমিজ। স্বামী মারা গেছেন। দুই শিশুসন্তান নিয়ে সংসার। তিনি রেশন হিসেবে পান আটা। তবে নিজের জন্য রেশন পেলেও সন্তানদের জন্য পান না।

রমনী বলেন, ‘বাগানের পুরুষ শ্রমিকরা স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য রেশন পায়। কিন্তু আমরা পাই না। এই বৈষম্য কেন? আমরা কি কাজ করি না? আমাদের কি ছেলেমেয়েরে খাওয়াতে হয় না?’

লাক্কাতুরা বাগানেরই শ্রমিক বিমল মোদী। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে ঝড়ে একটা গাছ আমার ঘরের ওপর পড়েছিল। আমি সেই গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করি। এ কারণে আমাকে এক সপ্তাহ রেশন দেয়া হয়নি।’

দলদলি বাগানের শ্রমিক ড্যানি নায়েক বলেন, ‘আমাদের বাগানে রেশন হিসেবে কেবল আটা দেয়া হয়। এসব আটাও খুব নিম্নমানের। কিন্তু শ্রমিকদের আটা থেকে চাল বেশি দরকারি।’

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের মজুরি বাড়িয়েছেন। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন মালিকপক্ষ যে সুবিধা দেয়ার কথা, সেগুলো ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে কি না তা তদারক করতে একটি কমিটি করে দেয়ার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই।’

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘বাগানের সব শ্রমিক রেশন পান না। কেউ এক দিন কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন পান না। এই যে তারা এতদিন আন্দোলন করেছেন, এই দিনগুলোর রেশন পাবেন না। এ ছাড়া যাদের চাষের জন্য জমি দেয়া হয়, তাদের রেশন দেয়া হয় না। ১২ বছরের ওপরের শিশুদেরও রেশন দেয়া হয় না।’

রেশনের ব্যাপারে চা সংসদের সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলি বলেন, ‘শ্রম আইন মেনেই চা শ্রমিকদের ভর্তুকি মূল্যে রেশনসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়। সব শ্রমিকই রেশন পান। শ্রমিকদের পোষ্যদেরও রেশন দেয়া হয়। এ ছাড়া অবসরে যাওয়া শ্রমিকরাও এ সুবিধা পেয়ে থাকেন।’