• ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

নীরব ভোটের আশা বিএনপির : উন্নয়নে ভরসা আওয়ামী লীগের

sylhetsurma.com
প্রকাশিত ডিসেম্বর ২৯, ২০১৮
নীরব ভোটের আশা বিএনপির : উন্নয়নে ভরসা আওয়ামী লীগের

২৬ ডিসেম্বর বুধবার, বিকেল সাড়ে তিনটা।  বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের সমনভাগ চা-বাগানের বাজার এলাকায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল নৌকা ও ধানের শীষ প্রার্থীদের পোস্টার। বাজারে অন্য অনেকের মতো জিনিসপত্র কিনতে এসেছেন শ্রমিক রাঙ্গা চরন।

পরিচয় দিয়ে ভোটের পরিবেশ নিয়ে কথা বলতেই বললেন, ‘আমরা তো শ্রমিক মানুষ। এখানে পরিবেশ ভালোই আছে। কোনো সমস্যা নাই। সুষ্ঠু পরিবেশে আমরা ভোট দিতে চাই, যার দ্বারা উন্নয়ন হয় গ্রামের। যিনি আমাদের দু:খ বুঝে। নিরাপদে চলা যায়। তারেই ভোট দিমু।’

বাজারে হাঁটতে হাঁটতে ভোট নিয়ে কথা হয় একই বাগানের শ্রমিক মাখন তাঁতীর সাথে।

তিনি বলেন, ‘লোকাই চোরাই কোনো লাভ নাই। বাগানের সরমিকরা (শ্রমিক) সারা জীবন নাউকায় (নৌকায়) ভোট দেয়। বাপ দাদা চৌদ্দ সিঁড়ি নৌকায় ভোট দিয়া আসিতেছি। তে আমরা আর কি বলিব। আমি ধানে ভোট দিলে কেউ মানি (মেনে) নিত নায়। তাই নৌকায় ভোট দিমু। এটা শেখের বেটির নৌকা।’

মাখন তাঁতীর সাথেই সুর মেলালেন নারী শ্রমিক অলকা। তিনি বলেন, ‘পঞ্চায়েত সব জানেন। এখন শান্তিতে আছি। নৌকায়ই ভোট দেব।’

একশ গজ দূরেই সমনভাগ চা-বাগানের ফ্যাক্টরি। বুধবার সাপ্তাহিক তলবের (মজুরি প্রদান) দিন। কেউ কেউ চায়ের পাতা তুলে পুটলা মাথায় নিয়ে ফিরছেন। কেউ ফিরছেন ট্রাক্টরে। তলব নিতে নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা জড়ো হয়েছেন। তাদের কাছে গিয়ে পরিচয় দিয়ে নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে কথাবার্তা শুরু করতেই যার যার মতো মন্তব্য করতে থাকেন। অনেকে আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোনে যান।

মন্টু রায় নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। পেটনীতি নিয়া আছি। আমাদের পেটের চিন্তা তো আগে। ভোট নিয়া চিন্তা করবো আমাদের পঞ্চায়েত নেতারা। ভোটের দিন কেন্দ্রে গিয়া দিমু এক জনরে।’

পাশে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করছিলেন নারী শ্রমিক অমি সাঁওতাল। ভোটের কথা তুলতেই বললেন, ‘নয় মাস আমাদের বিনা পয়সায় খাওয়াইছে কেডা। শেখ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) সাব। আমাদের জন্য অনেক করেছে। তাঁর মেয়ে (শেখ হাসিনা) নাউকা (নৌকা) নিয়া দাঁড়িয়েছে। শাহাব উদ্দিন আমাদের এমপি। ভোটটা আমরা তারেই দিমু। শাহাব উদ্দিন অনেক কিছু দিছে।’

বুধবার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যায় পর্যন্ত মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের বড়লেখা পৌর শহর, দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের সমনভাগ চা বাগান, স্থানীয় কলাজুরা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নির্বাচন নিয়ে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ভোটারের সাথে। এদের অনেকেই নির্বাচনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। আবার অনেকে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ভালো ভোট হবে, এই আশাবাদও আছে অনেকের। তবে সবার প্রত্যাশা একটাই-অবাধ, নিরপেক্ষও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন। যাতে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা না হয়।

কলাজুরা বাজারে বাবুল হোসেনের চায়ের দোকানে স্থানীয় মুরব্বি জহির আলীসহ ৭ থেকে ৮ জন চা খাচ্ছিলেন। অপরিচিত মানুষ দেখে কৌতূহলী চোখে তাকালেন। চায়ের দোকানের এক কোনে বসা সোহাগ আহমদের সাথে ভোট নিয়ে কথা তুলতেই কথা কেড়ে নেন জহির আলী।

তিনি বলেন, ‘আমরা এক ঘরের (এলাকার) মানুষ। মিলিমিশি খাইরাম (চলাফেরা করা)। কেউ ধানে ভোট দিবা কেউ নৌকায় দিবা। কিন্তু মাইর লাগাওরা এক পার্টি (দল) আছে। তারা বাইরে থাকি আইয়া মাইর (মারামারি) লাগায়।’

চায়ের দোকানি বাবুল হোসেন ও স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল ওয়াব বলেন, ‘আমাদের এখানে সম্প্রীতি আছে। কোনো সমস্যা হয়নি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই দলই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের দিন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণটা হয়ে গেলেই বাঁচা গেল।’

কলাজুরা থেকে ফেরার পথে কথা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক মাছুম আহমদের সাথে। মাছুম বলেন, ‘ভাই যে যাই বলুক নৌকা যাইব। কোনো সন্দেহ নাই।

নৌকা কেন পাশ করব? এই প্রশ্ন করতেই তিনি জানান, আমাদের এমপি যে উন্নয়ন করছইন। ইতা আর কোনো সময় অইছে না। তাই মানুষ নৌকারেউ পাশ করাইব।’

এ আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সরকারের দলীয় হুইপ ও বর্তমান সাংসদ মো. শাহাব উদ্দিন। অন্যদিকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপির নাসির উদ্দিন আহমদ মিঠু।

অপর দুই প্রার্থী সম্মিলিত জাতীয় জোটের আহমেদ রিয়াজ উদ্দিন (মোমবাতি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র গিয়াস উদ্দিন (হাতপাখা)।

এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৯ জন। চার প্রার্থী নির্বাচনে থাকলেও মূলত ভোটের লড়াই হবে নৌকা আর ধানের শীষের মধ্যে।

দুপুরে উপজেলা এলাকায় কথা হয় বিএনপি নেতা মঈন উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। মাঠ থেকে সরাতে মামলা দেওয়া হচ্ছে। ভয়ে অনেকে বাড়িতে থাকতে পারছেন না। তারপরও আমাদের প্রচারণা চলছে। জোর করে যদি ফল পাল্টে দেওয়া হয়। তাহলে কিছু করার থাকবে না। সুষ্ঠু ভোট হলে খেলা অন্যরকম হবে। ভোটের দিন বিপ্লব হবে। মানুষ নীরব ভোটে প্রতিবাদ করবে।’

এই এলাকায় কথা হয় কবির আহমদ নামের এক ফেরিওয়ালার সাথে। তিনি জানান, ‘মাইনষে (মানুষে) কেন্দ্রে গিয়ে ঠিক মতো ভোট দিলে রেজাল্ট অন্যরকম হতে পারে। বিএনপির নেতাকর্মীরা অনেক কৌশলী হয়ে তাদের প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন। আমরা গেরাম (গ্রাম) ঘুরি। কত মানুষের কথা শুনি। প্রচারণায় অনেককে দেখতে পাই। তবে বিএনপির লোকের প্রচারণার কৌশল ভিন্ন মনে হয়েছে।’

তবে কবিরের কথা শেষ না হতে হতেই তার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন সাথের ছুরুক মিয়া। তিনি বলেন, আমরা এই এলাকার ভোটার নই। হবিগঞ্জে বাড়ি। মাইনষে (মানুষে) খালি কৌশল দেখিয়া ভোট দিত নায়। উন্নয়নও দেখব। বর্তমান এমপি অনেক উন্নয়ন করছেন। এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য বর্তমান এমপির অনেক আন্তরিকতা আছে। মাইনষে ইতাও মাতে। আমার মনে হয় এলাকার উন্নয়ন যে করত পারব এরেই মানুষ ভোট দিবে।’

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি খ্যাত এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শাহাব উদ্দিনের ভরসা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, নিজস্ব ভোট ব্যাংক ও উন্নয়ন। তিনি গত দশ বছরে নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তাই ভোটের প্রচারে উন্নয়নের আলোচনাটাই বেশি।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, এই সরকারের আমলে বড়লেখায় শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ, ভবন নির্মাণ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া ছাড়াও মানুষ যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। তাতে তারা উন্নয়নের মার্কায়ই শামিল হবে। এমটাই তারা মনে করছেন।’

অন্য দিকে মামলার কারণে নেতাকর্মীর সংকটে ভুগলেও প্রচারণা চলে বিএনপি প্রার্থী নাসির উদ্দিন মিঠুর। বিএনপির প্রার্থী ও সমর্থকরা প্রচারণায় খালেদা জিয়ার মুক্তি আর নেতাকর্মীদের হামলা-মামলার বিবরণ তুলে ধরে ভোট প্রার্থনা করছেন মানুষের কাছে। তাছাড়া প্রচারণার ভিন্ন কৌশলে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেত-কর্মীরা নারীদের ভোট টানতে গেছেন বাড়ি বাড়ি। বেগম জিয়াসহ নেতাদের মুক্ত করতে ধানের পক্ষে ভোট চেয়ে নারী ভোটরের মন গলানোরও চেষ্টা করেছেন। নীরব ভোট বিপ্লবে জয় হবে এমনটাই তাঁদের বিশ্বাস।

বড়লেখা উপজেলা ছাত্রদলের নেতা জাহিদুল ইসলাম মতিন বলেন, ‘মামলা দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মাঠ শূন্য করে নির্বাচন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেক হয়রানি করা হচ্ছে। কেউ বাড়িতে ঘুমাতে পারছে না। তারপরও ভোটাররা নীরব। সুষ্ঠু ভোট হলে নীরবে ৩০ তারিখ ভোটাররা ভোট দিয়ে এমন বিপ্লব ঘটবে। যা এখনো কল্পনার বাইরে আছে সবার।’

বড়লেখা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তানিমুল ইসলাম তানিম বলেন, ‘আমাদের নেতা শাহাব উদ্দিন একজন সৎ ও সাদা মনের মানুষ। যে কোনো মানুষ উনার কাছে যেতে পারে। তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এই উন্নয়নেই মানুষ মূল্যায়ন করে ভোট দিয়ে জয়ী করবে। সাধারণ মানুষ নিজেদের উদ্যোগে নিজ খরচে নৌকার প্রচারণা চালিয়েছেন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন টিমে ভাগ হয়ে প্রচার কাজ করা হয়েছে। জয় আমাদের হবে।’

তপন কুমার দাস, বড়লেখা :::