• ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

পাপিয়া-সাবরিনার পর লোপা : কে গড়ে, কে ধরে?

sylhetsurma.com
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২০
পাপিয়া-সাবরিনার পর লোপা : কে গড়ে, কে ধরে?

 মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার ::: পাপিয়ার রেশ না কাটতেই এসেছিলেন সাবরিনা। সাবরিনার পর এখন লোপা। সময় বদলায়। নামও বদলায়। ঘটনা কিন্তু কাছাকাছি। ক্ষমতা এবং অর্থের উম্মাদনাই মূল বিষয়। তা পাপিয়া, সাবরিনা বা লোপা সবার ক্ষেত্রেই। লোপা সামনে এলেন শিশু অপহরণের ঘটনায়।

লোপার ফেসবুক প্রোফাইল বলছে, তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, কবি, এনজিও ব্যক্তিত্ব। আরো কতো কি? ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে তোলা তার কিছু ছবি পাপিয়া ধাঁচের। গত ক’দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে এগুলো। অপহরণ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তিনি জিনিয়াকে অপহরণ করেছিলেন টাকার লোভ দেখিয়ে।

পাচারকারী চক্রের সঙ্গে তার যোগাযোগের তথ্যও এসেছে। আর ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগাযোগ তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তবে, ঘটনাচক্রে ধরা পড়ে গেলে এগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নামে তুড়ি মেরে ধামাচাপা দিয়ে ফেলা হয়। সেইসঙ্গে থাকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না ইত্যাদি হুঙ্কার। গত রবিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে জিনিয়াকে উদ্ধার করে পুলিশ এবং নগরীর ফতুল্লার আমতলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় লোপাকে। তার ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। একবার তাকে ট্রিপল মার্ডার কেসে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এছাড়া তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগও ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ফুল বিক্রি করত জিনিয়া। তাকে গত ১ সেপ্টেম্বর অপহরণ করা হয়। ফেসবুক প্রোফাইলে উল্লেখ রয়েছে, তিনি অগ্নি টিভির এমডি, বাংলাদেশ আওয়ামী পেশাজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক।

দাবি করতেন বিভিন্ন সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল এবং টিভি চ্যানেলে সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার ছিলেন। এছাড়াও তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য বলেও পরিচয় দিতেন। প্রেসক্লাবের সদস্যও দাবি করেছেন। তার এতো পরিচয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারাও তাজ্জব বনে গেছে। তাদের কেস স্টাডিতে নতুন সংযোজন এটি। ফেসবুক পেজে মুজিব কোট পরে মন্ত্রী, নেতাসহ ক্ষমতাধরদের সঙ্গে লোপার পোজ দেয়া ছবি।

এ যাত্রায় ধরা না পড়লে লোপাও কবে টিভি টক শোতে আমদানি হয়ে যেতেন কে জানে! পাপিয়া বা লোপার তুলনায় সাবরিনা চৌধুরীর কেস কিছুটা ভিন্ন। মেধাবি ছিলেন বলেই মেডিকেলে টিকেছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি নানা পরীক্ষা দিয়েই একজন কার্ডিয়াক সার্জন হয়েছেন। পরিচিতি, সম্মান, এমন কি অর্থ উপার্জনের জন্য এই যোগ্যতাটি যথেষ্টই ছিল।তারওপর সুন্দরী, গ্ল্যামারাস। চাইলে নিজের ইউটিউবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারতেন। অথচ বেছে নিলেন অন্ধকার আর দুর্নীতির পথ। ভেবে পাওয়া কঠিন কেন এমন নোংরা-কদাকার সুড়ঙ্গে ঢুকলেন তিনি। জিনের ভেতরেই কি লুকিয়ে ছিল নষ্ট বীজ? যোগ্যতা বিশেষ করে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে এবং চাহিদা অসীম হলে, মানুষ অধপতিত হয়।

কেউ আটকাতে পারে না। সামাজিক এবং মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, এনিম্যাল ইন্সটিনক্টই মনুষ্যত্ব মানুষের ড্রাইভিং ফোর্স। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে যার সুযোগ আছে সেই অন্যায় করে। যেখান দিয়ে যে সুযোগ পায় ঘটিয়ে বসে। আর ক্ষমতার পিরামিডের যে যত উপরে তার অন্যায় করার ব্যাপকতা তত বেশি। তা একজন কার্ডিয়াক সার্জন সাবরিনা হোক আর পাপিয়া-লোপাই হোক। তারা সৌন্দর্য আর গ্ল্যামারকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জনকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এই শ্রেণিটা জানে কিভাবে তাদের সৌন্দর্য আর গ্ল্যামারকে কাজে লাগিয়ে পুরুষ আর সিস্টেমকে বধ করতে হয়। এটা নতুন কিছু নয়। তবে, গত বছর কয়েকে এর ব্যাপকতা বেড়েছে। কোনো সীমা পরিসীমার মধ্যে নেই। আর সেখানে কিছু পুরুষের অবদান সবসময়ই থাকে।

পাপিয়ার ঘটনার সময় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রের, প্রশাসনের, ক্ষমতাসীন দলের বিগ শটদের সঙ্গে তার মাখামাখির প্রচুর ছবি দেখেছে মানুষ। জেনেছে বহু তথ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না পাপিয়া, লোপা বা সাবরিনাদের অনৈতিক ক্রিয়াকর্ম তথা আয়-রোজগার ও দাপট নিশ্চিৎ করতে ক্ষমতাসীন দলের সম্পৃক্তা তাদের খুব দরকার। কিন্তু, ক্ষমতাসীন দলের কি খুব দরকার এই কীটসমদের? তা-ও দেশের প্রাচীন ও কর্মী-সমর্থকে ঠাঁসা দলটির? এ দলকে ক্ষমতায় আনতে বা রাখতে কী অবদান এই পাপিয়া-লোপাদের? তা’হলে সরকার এদের দায় টানে কেন? মাঝেমধ্যে দুয়েকটাকে সাইজ করে। ক’দিন পর নতুন গজায়।

চালের আড়তের স্যাম্পলের মতো এরা। সামনে ছোট ছোট বাটিতে চালের স্যাম্পল রাখা থাকে। পেছনে বা অদূরে থাকে বস্তায় বস্তায় থরে থরে সাজানো চালের বস্তা। আরেকটু দূরে বা কাছে কিনারে নানা জাতের-নামের সম্রাট, সাহেদ, শামিম, পাপিয়া, সাবরিনা লোপার আড়ত। হয়তো টিস্যুর মতো উড়ে আসা লোপা ইস্যুও হারিয়ে যাবে। সাহেদ-সাবরিনারা এরইমধ্যে বাসি হয়ে গেছে। পাপলু- পাপিয়া, শামীম-সম্রাট-খালেদরাও আড়াল হয়ে গেছে। করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতি করার কারণেই সাহেদ, পাপিয়া, আরিফ বা মানবপাচার করার কারণেই পাপুলরা ফেঁসে গেছেন এমনটি বিশ্বাস করতেই হবে? গোলমাল বা ভেজালটা আসলে কোন জায়গায়? ইয়াবাসহ মাদকের বাদশা বদিকে এক ঝলক সাইজ করে তার বৌকে এমপি করা হয়েছে।

পাপিয়া যায় সাবরিনা আসে। শামিম যায়, সাহেদ আসে। আরিফ আসে। আসতেই থাকে। তাদের ফ্যাক্টরি বা উৎপাদনস্থল কোথায়? কে, কারা তাদের জন্মদাতা? তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো তাগিদ কি আছে? তাদেরকে যারা সাহেদ, সামিম, সম্রাট, সাবরিনা, পাপুল, পাপিয়া, লোপা করে গড়ে তোলে তারা কি অচেনা? ঘটনাচক্রে অপরাধ ধরা পড়ার পর কেউ আর তাদের দায়ও নিতে চায় না। চেনে না তাদের দলও। চিনলেও বলে দেন, এটা বিএনপির প্রোডাক্ট। সে আগে বিএনপি করতো। এক সময়ের যে মিসকিন-খয়রাতিরা গত বছর কয়েকে নামকরা জালিয়াত, টেন্ডারবাজ, মাদক সম্রাট, মক্ষিরানী হয়েছে এদের বেশির ভাগকেই এক সময়ের বিএনপি নামে চেনানোর চেষ্টা চলে আসছে। এ বিষয়ক স্ক্রিপ্ট প্রায় একই। বিএনপি হওয়ার পরও এগুলোকে লালন করেন কেন? পাপের কলস পূর্ণ করে এরা ধরা পড়লেই বা কী যায়-আসে?

 

লেখকঃ সাবেক কাউন্সিলর বিএফইউজে-বাংলাদেশ _| সদস্য – ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন( ডিইউজে) _| বিশেষ প্রতিবেদকঃ শ্যামল বাংলা ডট নেট ও শ্যামল বাংলা টিভি _|