• ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

ধর্ষক-ভক্ষকরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী ?

sylhetsurma.com
প্রকাশিত অক্টোবর ৩, ২০২০
ধর্ষক-ভক্ষকরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী ?

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার : ভাব-নমুনা এবং ক্রিয়া-কর্মে তারা করোনার চেয়েও শক্তিশালী। এই মহামারিতে জাত ক্রিমিনালদের অনেকে সমঝে গেছে। কিন্তু ধর্ষক, চোরাকারবারী, অর্থ-মানব পাচারকারী, কালোবাজিরীরা কাবু নয়। ভীত নয়। দুর্দমনীয়-পরাক্রমশালী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বরং করোনা যেন তাদের কাছে সুবর্ণ মৌসুম।

করোনার ভয়-আতঙ্ককে কেবল চুরি-জারীয়াতি নয় , ধর্ষণের মোক্ষম সময়ও মনে করছে কেন তারা? রীতিমতো গবেষণার বিষয়। কোথায় মিলছে অভয়? যা জন্তুরাও করে না। কিন্তু তারা করে। ধর্ষণ করে। ধর্ষণের প্রতিবাদেও থাকছে সবার আগে। স্লোগান ধরে জোর গলায়। দেশে-সমাজে নেতৃত্ব দেয়। নেতৃত্ব দেয়। জন্তুরা তা করে? বাঘ হরিন খেয়ে হরিন রক্ষার সভায় সভাপতিত্ব করে না। বিড়াল মাছ খেয়ে মাছের বন্ধু সাজে না। কাক মুরগীর ছানা চুরি করে শিশু অধিকারের জন্য হাঁক ছাড়ে না। এই পোদ্দারী কেবল মানুষ নামের চোর-ধর্ষক, জালিয়াত-কালোবাজিরা। ঘরে কাজের মেয়েকে কথায় কথায় গালমন্দ করে, পিটিয়ে, খুন্তির ছ্যাঁকা সেমিনারে গিয়ে নারী ও শ্রম অধিকার নিয়ে প্রবন্ধ পড়ে। করোনা তাদের যেন আরো আগুয়ান-বেগবান করেছে। তা কি তারা করোনার চেয়েও শক্তিশালী বলেই?

করোনার শুরুর দিকে অভাবীদের ক্ষুধা নিবারণের কিছু চেষ্টা চলেছে। ফটোসেশনের জন্য হলেও কিছু ত্রান-দান চলেছে। এই সুযোগে অভাবীরা টুটটাক কিছু পেয়েছে। ধীরে-ধীরে সেটা কমেছে। কমতে-কমতে এখন চলে এসেছে ‘নাই’ পর্যায়ে। সঙ্গে যোগ হয়েছে তামাশা। কেবল নেতা নয়, আতিপাতিরাও দেখিয়ে দিচ্ছে তামাশার নিষ্ঠুরতা। নেতাদের সঙ্গে খায়খাতির রেখে চলা মাইক ম্যানরাও এখন জননেতা স্টাইলে ত্রাণ নাটকে জব্বর পারফরমেন্স দেখিয়ে চলছে। বহু ‘ঐতিহাসিক জনসভায়’ এই মাইকম্যানরা একমাত্র শ্রোতা হিসেবে থাকলেও এখন শেয়ানা বক্তা, দানবীর, ত্রাণের ত্রাতা। ভাষণের তেজ বেড়েছে। ব্যবসার প্রসার তো ঘটেছেই। আসরে পেগ চলে আগের নেতার চেয়েও বড় নেতার সঙ্গে। জনগণের পাশে ছিলাম-আছি বলে ভাষণ দেন উভয়ই। রুচি ও খাদ্যে বেশ মিল তাদের। মানুষের সহনশীল হওয়া ছাড়া যেন কোনো হতি নেই। হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও রিলিফ চোরদের বাঁচানোর লোকের অভাব হয়নি। এই দুর্যোগ ও মহামারিতেও চাল-তেলসহ রিলিফ চুরিতে পারঙ্গমদের পক্ষে যে কোনো কাজ করাই সম্ভব। তাদেরকে যারা রক্ষা করেন তারাও মহান। ধর্ষকদের রক্ষার লোকের অভাব হচ্ছে না।

করোনা, বন্যা, ঝড়-ঝঞ্জা তাদের জন্য আশীর্বাদ হচ্ছে। তারা গড়ের অংকে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। মাথাপিছু হিসাবে আয় বাড়ছেই মানুষের। চলতি বছরের মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকে টাকা জমানোর হিসাবটা দেখলে এর সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ নেই। কঠিন এই চার মাসে দেশে নতুন কোটিপতি বেড়েছে ৩ হাজার ৪১৩ জন। এই মহান কারা? কিভাবে? এসব প্রশ্নের কিঞ্চিত জবাব আছে স্বাস্থ্যের ড্রাইভার মালেকের মধ্যে। প্রশ্ন আরো আছে। যাদের আদর-সমাদর, আস্কারাসহ যাবতীয় আনুকূল্য এদের এই চুঁড়ায় তুলেছে, সেই মাননীয়রা ভিন্ন কোনো গ্রহে থাকেন? মালেকের সব মাল কি ধরা পড়েছে? তার আগে- পিছে যেসব মাল-মালিক ছিল, তারা কই? দুয়েকটা ড্রাইভার, পিয়ন-চাপরাশিকে সামনে ছুঁড়ে দিয়ে তথ্য বিনোদনের যোগান হয়েছে সত্য। মালেক ড্রাইভারে বুঁদ হয়ে ট্রলে আসক্ত অনেকে। যেন এই মালের বাইরে আর কোনো মাল নেই। ছিলও না কখনো। সরকারি একটি অফিসের ড্রাইভার নিশ্চয়ই দুচার মাস বা বছরে এতো ধনে ধান্য হয়েছে? ঢাকায় মাত্র ২৪টা ফ্ল্যাট, সাততলা ৩টা বাড়ির কর্মযজ্ঞ গোপনে হয়েছে? কোনো মহান, মাননীয়, মান্যবর তা দেখেননি? শোনেনওনি? জেনেছেন র‍্যাব ধরার পর? একদল আবার ড্রাইভার মালেককে বলছে চুনোপুটি। তা’হলে রুই, কাতলা, বোয়ালগুলোর সাইজ কেমন হতে পারে? ভাবা যায়? মাথা ঠিক থাকে? স্বাস্থ্যের বিশাল নদীতে পদের বিচারে মালেক-আবজালরা চুনোপুটি হতে পারে। তবে, জানার অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছে- টেংরা-পুটি এত বড় হলে বোয়ালগুলোর সাইজ কেমন?

 

ড্রাইভার মালেকের পর্বতসমান দুর্নীতির ঘটনাটা স্বাস্থ্য বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের সমস্যা? অথবা ইউএনও ওয়াহিদার হাতুড়িঅলা মালি রবিউল কি ঘোড়াঘাটের প্রশাসনের চিত্র? না-কি গোটা প্রশাসনিক –সামাজিক ব্যবস্থার দুর্নীতিপরায়নাতার প্রমান? কারো আপত্তি বা বিতর্ক থাকার কথা নয়- রাষ্ট্রে সুশাসন বলবত থাকলে , সমাজে নৈতিকতার চলন থাকলে এদের জন্ম হলেও এতোদূর আসার কথা নয়। যাদের আদর-সমাদর, আস্কারাসহ যাবতীয় আনুকূল্য এদের এই চুঁড়ায় তুলেছে, সেই শক্তিমানরা অধরাই থাকছে।

করোনার উছিলায় আবজাল- মালেকসহ স্বাস্থ্যের মৌ-লোভীদের কথা জেনেছে মানুষ। প্রসঙ্গ বা ঘটনা এলে অন্যান্য সেক্টরের মধুখোরদের কাণ্ডকীর্তিও সামনে আসবে। জিকে শামীম, সম্রাট, খালেদ, পাপিয়া, সাহেদ, সাবরিনাদের সুবাদেও কম জানা হয়নি। নানা ইস্যু এবং ঘটনার ঘনঘটায় আমরা এসব ভুলে যাবো । কেরানি আবজল, মালেক ড্রাইভার বা মালি রবিউলের কথা মনে করিয়ে দিলেও হয়তো স্মৃতিতে আসবে না। করোনা যেন প্রেরণা জাগিয়েছে মানবপাচারকারীদেরও। ক্ষেত্রবিশেষে আরো ডেমকেয়ার-বেপরোয়া। পাচারকর্মের ধরন তথা কলাকৌশলে আরো আপডেট এনেছে। কেবল বেকার বা কাজ পাগল যুবক নয়, নারী এমন কি শিশুদেরও টার্গেট করছে। যা অনেকের ধারনায়ও ছিল না। সম্প্রতি এই চক্রের কিছু চুনোপুটি বা দালাল ঘটনাচক্রে ধরা পড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও হতবাক। এমন কঠিন মহামারিতেও এরা এতো তৎপর যা কল্পনারও বাইরে। এই চক্রের কেউ কেউ রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে সমাজপতি এমন কি রাজনীতিক বনে যাচ্ছে। নিজেদের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী-দানবীর পরিচয় দিয়ে এলাকা মাত করে দিচ্ছে। মোটা অংকের কামাই রোজগারের প্রলোভনে বিভিন্ন দেশে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করানো তরুণি-যুবতীদের ফলো আপ খবর নেই। সৌদিসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কতো বাঙালি নারীর বিলাপ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে তার সঠিক হিসাব নেই কারো কাছে। এ হিসাব উদ্ধার করাও কঠিন। পাসপোর্ট, ভিসা, বিদেশ যাওয়াসহ তাদের কাজই হয়েছে গোপনে। রসিকতাচ্ছলে অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশের এই চক্রের কাছে বিদেশিদের অনেক কিছু শেখার আছে।

করোনা চিকিৎসায় এমন কি পজেটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে বাণিজ্যেও বুক কাঁপেনি ঠকবাজদের। সুস্থ্ হওয়া করোনা রোগীর প্লাজমা নিয়ে কুব্যবসাও বাদ যায়নি। চারদিকে উল্টা যতো ক্রিয়াকর্ম। মহামারী বরং অনেককে আরো বেপরোয়া করছে। মওকা করে দিচ্ছে কোটি-কোটি টাকা হাতানোর। পুকুর চুরির বদলে বেড়েছে সাগর চুরি। এই দুর্যোগের মাঝেও বোরোর বাম্পার ফলন ফলিয়েছে কারা? কৃষকরা। তাদের কল্যাণে কারো মন গলেছে? ধান-চালের বাজারে নতুন মজুতদার যোগ হয়েছে। তাদের একেকটা প্রতারণাবিশারদ। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ মৌসুমি ফলের বাজারেও কুকর্মের শিরোমনিদের দাপট। সঙ্গে আদর কদর। ক্যামিকেলের ছড়াছড়ি। এমন মহামারিও দুষ্টুচক্রের জন্য সুসংবাদ। প্রতিদিন মানুষ মরছে, বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অব্যাহত চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে, শিশু অপহরণ হচ্ছে, নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে, জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কয়টা ঘটনা জনসমক্ষে প্রচার হয়? করোনার শুরুতে কয়েকদিন ধর্ষণের খবর কম ছিল। এখন সেটাও ভরিয়ে দেয়া হলো ষোলোকলায়। সব মিলিয়ে অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, কোনো ঘটনাই আর দেশে ঘটনা নয়। আর দুর্ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এসব করে প্রদীপদের গুলি করে সিনহা হত্যা, হাতুড়ি বাহিনীতে ওয়াহিদা- বদরুলদের পঙ্গু করে দেওয়ার ঘটনার ওপর ধামা বসিয়ে চাপা দেওয়ার ক্যারিশমা দেখানো হচ্ছে। সাবেক মেজর হত্যা, ইউএনওকে হাতুড়িপেটা ছাড়াও মিন্নি, নুসরাত, খাদিজা, ত্বকী, ছেলেধরা সন্দেহে মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বানানো, খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, অমুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট দেওয়া, ক্যাসিনো, বালিশ- পর্দা কাণ্ড, রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্টে লোহার জায়গায় বাঁশ দেয়া, বাসের ভেতর গণধর্ষণ, বাস থেকে যাত্রীকে ফেলে তার বুকের উপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়া, সবই একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। চলমান ধর্ষণ-গণধর্ষণও তাই?

লেখক: বিশেষ প্রতিবেদক, শ্যামল বাংলা ডট নেট ও শ্যামল বাংলা টিভি।

তথ্য সূত্র : মানবকন্ঠ, লিংক সংযুক্ত