• ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

অভিভাবকদের অসন্তুুষ্টি চরমে : শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে মন্ত্রনালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা

sylhetsurma.com
প্রকাশিত জানুয়ারি ৯, ২০১৮

মনগড়া খাত তৈরী করে অতিরিক্ত টাকা আদায়

মো. সাজন আহমেদ রানা, মৌলভীবাজার থেকে :
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে তিনগুন পর্যন্ত বেশী ভর্তি ফি নিচ্ছে। এমনকি খোদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোবাশশেরুল ইসলাম স্কুল কর্তৃপক্ষের অনিয়মতান্ত্রিকভাবে আরোপিত অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে তার সম্মতি প্রদান করেছেন! যিনি শ্রীমঙ্গল উদয়ন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমান আহবায়ক কমিটির প্রধান। আবার তিনিই বলছেন, এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় কার্যক্রম বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে এ অনিয়ম বন্ধ করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা তিনি গণমাধ্যমকে জানান। বিভিন্ন অভিযোগ ও অনুসন্ধানে উঠে আসে, শ্রীমঙ্গলস্থ সেন্ট মার্থাস উচ্চ বিদ্যালয়, উদয়ন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, দি বার্ডস রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়, বর্ডার গার্ড উচ্চ বিদ্যালয়, কর্তৃপক্ষ সরকারী পরিপত্রে উল্লিখিত সর্বসাকুল্য টাকার পরিমানের চেয়ে কয়েকগুন বেশী টাকা গ্রহণ করে এবং অভিভাবকরা একপ্রকার জিম্মি ও বাধ্য হয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করছেন। শুধু তাই নয়, এমপিও’র বাইরে থাকা সেন্ট মার্থাস উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারী কারিকুলামের বাইরের বই আত্মস্থকরণের জন্য কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের উপর বাড়তি বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দিচ্ছেন, যার খরচ প্রদান করতে হচ্ছে অভিভাবকদের। বাডর্স রেসিডেনন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ফি’র চাইতে আটগুন বেশী অর্থ আদায় করছে অনেক বছর ধরে চলে আসা নিজস্ব প্রথা শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে! শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত হারের চেয়ে গড়ে দ্বিগুন অর্থ নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। মোটকথা, সরকার নির্ধারিত সর্বসাকুল্য অর্থের চেয়ে অনেক বেশী অর্থ আদায় করছেন বিদ্যালয় সমুহের কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে জানতে সেন্ট মার্থাস উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে, সাংবাদিকদের বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। প্রধান শিক্ষিকা ব্যস্ততার ছুঁতোর কথা ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মাধ্যমে জানিয়ে দেন এবং স্কুল অফিস সূচীর বাইরে সন্ধ্যার পর মোবাইল ফোনে কথা বলবেন বলে জানান। গোপন সুত্রে জানা যায়, তিনি ছাত্রছাত্রীদেরও সাংবাদিক এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন এবং অভিভাবকদের কেউ যদি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যেকোন আদেশ-নির্দেশ-উপদেশ বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ না করেন তাহলে সন্তানকে অন্যত্র পড়ানোরও জন্য পরামর্শ দেন। সাংবাদিকদের সাথে তার এহেন আচরণ অবহিত হয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক।
ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অয়ন চৌধুরী বলেন, আমরা প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ দিচ্ছি। তাই অন্যদের থেকে একটু বেশী নিতে হয়।
উদয়ন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বলেন, ইউএনও স্যারের সাথে আলোচনাক্রমে ৫০০ টাকা অতিরিক্ত নিচ্ছি।
সিলেট বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক, মইনুল ইসলাম জানান, আমরা ভর্তির বিষয়টি মনিটরিং করি না। এটি উপজেলা বা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় ও প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে ইউএনও দেখে থাকেন।
শ্রীমঙ্গলের বিদ্যালয় সমুহের অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দিলীপ কুমার বর্ধন ভর্তিতে টাকা বেশি নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন এর আগেও অনুরুপ অভিযোগ এসেছিল। এবারও মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের বাইরে গিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবহিত। ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কর্মকান্ড বিতর্কিত। কিছুদিন আগে তিনি ‘আপন আলোয় বিশ্ব ভুবন’ নামক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক একটি সংকলনে ‘ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি’ হয়েছে মর্মে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারী পত্র প্রেরণ করে একটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বঙ্গবন্ধুর সংকলন বিতরণের কারন জানতে চান। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঐ কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজেরা উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করেন। এ শিক্ষা কর্মকর্তা নিজে উদ্যোগী হয়ে কোন অভিযোগ/অনুযোগ বিষয়ক কাজ করতে চান না। উপরের দোহাই দিয়ে সময়ক্ষেপণ ও এড়িয়ে যাবার পায়তারা করেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোবাশশেরুল ইসলাম বলেন, আমি শুধু উদয়ন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যাপারে জানি যেহেতু আমি এটি ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। অন্যগুলোর ব্যাপারে আমার জানা নেই। তবে আমি পর্যবেক্ষণ করছি। উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন খাতওয়ারী অতিরিক্ত ৮০০ টাকা আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যা আমি পরবর্তীতে কমিয়ে ৫০০ টাকায় নির্ধারণ করেছি। লিখিত অভিযোগ পেলে বা প্রয়োজনে ৫০০ টাকা গ্রহণের এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হবে।
মৌলভীবাজার জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ এস এম আব্দুল ওয়াদুদ জানান, এরকমটি হয়ে থাকলে তা অনিয়ম। আমি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে খবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আজই বলে দিব।
মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেটের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বাইরে কোন অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা যাবে না। অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ব্যাপারে কারো নির্দেশনা অগ্রহণযোগ্য, কেউ এরকম করে থাকলে তা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের নির্দেশনার সুস্পষ্ট উপেক্ষা, এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান শুন্য সহনশীলতার (জিরো টলারেন্স) পর্যায়ে রয়েছে। আমি নিশ্চিত করছি ও আস্বস্থ করছি, বিদ্যালয় গুলোর অনিয়মতান্ত্রিক টাকা আদায় ও অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে সত্বর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহকারে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করা হবে।
শ্রীমঙ্গলের সচেতন অভিভাবক ও সুধীজনরা মনে করেন, এটি শিক্ষাক্ষেত্রে একটি দুর্নীতির উদাহরণ। প্রান্তিক পর্যায়ে এরুপ অনিয়মের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্থরা। সরকার ও মন্ত্রণালয়ের যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকার পরও এসব অনিয়ম ও অনিয়মতান্ত্রিকতার কারনে বিপর্যস্ত হচ্ছে শিক্ষা খাত।

লেখক-মো. সাজন আহমেদ রানা
মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি
দৈনিক জনতা