গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রধান মাধ্যম হলো নির্বাচন। নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রক্তপ্রবাহের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হবে। ভোটাররা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন।
অর্থ ও পেশি শক্তির প্রভাব থাকবে না। একইভাবে মানুষ আশা করে, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, যা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। তাদের সুপারিশের ওপর জাতীয় ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে।
এই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তা ছাড়া সংস্কার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অল্প সময়ে অনেক বিষয় পরিবর্তন করলে সব সময় সঠিক ও কাঙ্ক্ষিত ফল না-ও আসতে পারে। এখানে দুটি বিষয় রয়েছে।
প্রথমটি হচ্ছে মৌলিক বিষয়গুলো, যেগুলোতে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করে আইনে পরিণত করে বাস্তবায়ন করলে সেগুলোতে নির্বাচিত আইন সভায় অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে সেগুলো অনুমোদন করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি থাকা জরুরি। অবশিষ্ট বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে সংস্কার করবে তার একটি বিবরণ থাকা উচিত। ছাত্র-জনতার কাছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে বিচারপ্রক্রিয়া। এ বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে তাদের সুস্পষ্ট নীতি উল্লেখ থাকা উচিত।
দুর্নীতি দেশের অন্যতম সমস্যা। দুর্নীতির কারণে দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সুশাসন ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতি সব মাত্রা অতিক্রম করেছিল। তাই দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট আগামী নির্বাচনে অন্যতম প্রধান ইস্যু হবে। রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করবে এবং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, সে সম্পর্কে ইশতেহারে সুস্পষ্ট বার্তা থাকা উচিত।
দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের বেকারত্বের হার ৪.৬৩ শতাংশ, যদিও এই তথ্যের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ আছে। এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার যুবক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পাস করে বের হচ্ছেন। তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেকোনো সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কিভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে এবং বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করবে, ইশতেহারে তারও উল্লেখ থাকতে হবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। নির্বাচিত সরকারের কাছে দ্রব্যমূল্য হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ও নীতি নির্ধারণের বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা রয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে মুদ্রানীতি কী হবে, বাজার ব্যবস্থাপনা কিভাবে করবে, সরবরাহ শৃঙ্খলার উন্নয়ন কিভাবে করবে তার সুস্পষ্ট নীতিমালার উল্লেখ থাকা উচিত ইশতেহারে।
দেশে আইনের শাসন দুর্বল। উন্নত দেশের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচলিত রীতি ও আইন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত, আদেশ ও নির্দেশ তাদের কাছে অনেকটা আইনে পরিণত হয়। প্রশাসনের কর্মকর্তারা দলীয় কর্মীতে পরিণত হন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এ অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। এ সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ছিল অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার টিকিয়ে রাখার রক্ষাকবচ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান জনগণকে নাড়া দিয়েছে। জনগণ পরিবর্তন চায়। তাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। জনগণ আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে এর নিশ্চয়তা চায়। তাই আমার মনে হয়, নির্বাচনী ইশতেহারে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বার্তা থাকা উচিত।
বৈদেশিক নীতি নির্বাচনী ইশতেহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। বৃহৎ শক্তি হিসেবে চীনের উত্থানে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই অঞ্চল পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হওয়ায় চীন এই অঞ্চলকে নিরাপদ ও অন্যান্য বৃহৎ শক্তির প্রভাবমুক্ত রাখতে চায়। অন্যদিকে চীনের উত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় এই অঞ্চলে কূটনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারি ও সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করেছে। চীনকে ভূ-রাজনৈতিক চাপে রাখতে চায়। এই অঞ্চলের মধ্যে উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর অঞ্চল তাদের উভয়ের কাছে অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ। আর উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ ও মায়ানমার ভূ-কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের ভূ-কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশের একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে স্বার্থ সংরক্ষণ করা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। সুতরাং নির্বাচনী ইশতেহারে কিভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে স্বার্থ সংরক্ষণ করবে তার প্রতিফলন থাকা উচিত। সর্বশেষে প্রত্যাশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর এবারের নির্বাচনী ইশতেহার গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে আসবে। জনমুখী ও নীতি নির্ভর হবে। পপুলিস্ট বক্তব্য কম থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ