• ১৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

বাংলাদেশের ব্লু কার্বন ও পরিবেশ সচেতনতার নতুন দিক

sylhetsurma.com
প্রকাশিত আগস্ট ১৭, ২০২৫
বাংলাদেশের ব্লু কার্বন ও পরিবেশ সচেতনতার নতুন দিক

Manual6 Ad Code

বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবগুলো পৃথিবীজুড়ে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি এই সব কিছুই জন-জীবনকে প্রতিনিয়ত এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তবে এই সকল সংকটের মাঝেও রয়েছে একটি সম্ভাবনার সঞ্চারক শক্তি যার নাম ব্লু কার্বন। ভবিষ্যতে যা আমাদের সামনে একটি নতুন উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।

ব্লু কার্বন মূলত সমুদ্রের উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র যেমন ম্যানগ্রোভ বন, লবণাক্ত জলাভূমি এবং সমুদ্রের তৃণভূমিতে সঞ্চিত কার্বনকে বোঝায়। এই বাস্তুতন্ত্রগুলো কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং তা মাটিতে বা পলিতে জমা রেখে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্ব রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ব্লু কার্বন যে শুধু একটি পরিবেশগত ধারণা তা নয় বরং এটি একটি নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্ত্র, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এক বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে চলেছে।

এক্ষেত্রে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি একত্রে ব্লু কার্বন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তবে তা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিবেশগত অধিকার এবং অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করবে। এই প্রকল্পগুলো গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমিয়ে, প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অনুযায়ী পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের ব্লু কার্বন ও পরিবেশ সচেতনতার নতুন দিক
বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায্যতা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির চ্যালেঞ্জ

এছাড়া, ব্লু কার্বন প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে কার্বন ক্রেডিট সৃষ্টি হতে পারে, যা দেশগুলোকে তাদের নির্গমন লক্ষ্য (emission target) পূরণে আর্থিক সুবিধা প্রদান করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে পেরুর কথা। দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি তাদের ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি বছর কয়েক হাজার টন কার্বন শোষণ করে, যার মাধ্যমে দেশটি প্রতিবছর ব্যাপক হারে কার্বন ক্রেডিট অর্জন করে আসছে। একইসাথে ক্রেডিটগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির মাধ্যমে পেরু আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবিকা এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য সহায়ক কর্মসূচি তৈরি করছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এমন একটি দেশ, যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের উল্লেখযোগ্য অংশ অবস্থিত যার আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন প্রতি বছর প্রতি হেক্টরে ১.৫ থেকে ২.৫ টন কার্বন শোষণ করতে সক্ষম। উল্লেখযোগ্য এই প্রাকৃতিক সম্পদ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং ক্ষয়প্রবণতা থেকে রক্ষা করে, যা বাংলাদেশের জলবায়ু নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখছে।

তাই ব্লু কার্বন, যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য পরিবেশগত গুরুত্বই বহন করে তা নয়, বরং এটি একটি কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। যা অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সক্ষম। বিশেষত, প্যারিস চুক্তির মতো বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তির বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, যদি বাংলাদেশ ব্লু কার্বন প্রকল্প গ্রহণ করে। এটি যদি সম্ভব হয় এবং প্রতি বছর যদি বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করা যায়, তাহলে উন্নত দেশগুলো তাদের নির্গমন লক্ষ্য (emission target) পূরণের জন্য বাংলাদেশের ব্লু কার্বন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হতে পারে। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অভূতপূর্ব সুযোগ পাবে বলে আশা করা যায়।

অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দীর্ঘকাল ধরেই সীমান্ত বিতর্কের মধ্যে রয়েছে, বিশেষত ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমান্ত নিয়ে। তবে ব্লু কার্বন প্রকল্প এই সমস্যা সমাধানে একটি সম্ভাব্য পথ তৈরি করতে পারে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশগত সহযোগিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব, যা শুধু পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না, বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও শক্তিশালী করবে।

Manual5 Ad Code

২০২৩ সালের বিশ্ব ব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈশ্বিক কার্বন ক্রেডিট বাজারের মূল্য ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল যা ২০৩০ সালের মধ্যে এটি আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ মোট ২.৫৩ মিলিয়ন (২৫ লাখ ৩০ হাজার) কার্বন ক্রেডিট বিক্রি করেছে, যার মূল্য $১৬.২৫ মিলিয়ন (প্রায় ১৭০ কোটি টাকা)। তবে এ আয়ের প্রধান উৎস ছিল উন্নত রান্নার চুলা এবং বাকি আয় এসেছিল সোলার হোম সিস্টেম থেকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে উক্ত দুই ক্ষেত্রের পাশাপাশি ব্লু কার্বন ক্রেডিটও বাংলাদেশের জন্য এই বিশাল বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে বলে আশা করা যায়। যেখানে পেরুর মতো একটি দেশ ইতোমধ্যে লাভজনকভাবে ব্যবহার শুরু করছে। ব্লু কার্বন ক্রেডিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি এই স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

এছাড়া, সুন্দরবন এবং অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে ব্লু কার্বন প্রকল্প বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নতুন গতির সঞ্চার করতে পারে। UNESCO দ্বারা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন এবং দেশের অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলের সৌন্দর্য আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্লু কার্বন প্রকল্পের মাধ্যমে এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলো সংরক্ষণ ও উন্নত করা হলে, পর্যটন খাতের সম্প্রসারণ সম্ভব হবে, যা দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে।

Manual4 Ad Code

অন্যদিকে, ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল যেমন Green Climate Fund এবং World Bank Blue Economy Program থেকে অনুদান ও বিনিয়োগ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। উদাহরণস্বরূপ, মালদ্বীপ তাদের সামুদ্রিক সুরক্ষা উদ্যোগকে COP আলোচনায় তুলে ধরে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে সহায়তা লাভ করেছে, যা বাংলাদেশেও ব্লু কার্বন প্রকল্পের মাধ্যমে অর্জন সম্ভব। এই প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

Manual7 Ad Code

বিশ্ব রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্লু কার্বন বাংলাদেশকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ প্রদান করে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক তহবিল ও প্রযুক্তি সহায়তা পাওয়া, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং কার্বন ক্রেডিট বাজারে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভ অর্জন। তবে এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে নীতি, গবেষণা, প্রযুক্তি এবং জনসম্পৃক্ততার মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

Manual7 Ad Code

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশ যদি ব্লু কার্বনকে শুধুমাত্র “প্রাকৃতিক সম্পদ” হিসেবে না দেখে, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী “কূটনৈতিক সম্পদ” হিসেবে ব্যবহার করে, তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের অবস্থান আরও দৃঢ় এবং কার্যকর হতে পারে।

শমরিতা বড়ুয়া : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়